বাংলাদেশের শেয়ার বাজার : বিপর্যয় কি আসন্ন?
প্রকাশিত: সাপ্তাহিক, ২৩ ডিসেম্বর ২০১০
বাঙ্গালীদের জুয়াখেলার অভ্যাস সনাতন। আবেক ভালবাসা অতুলনীয়।
কিন্তু শেয়ার বাজারে এ দু’টোর কোনটারই যে এক পয়সাও মূল্য নেই সেটা এক দশকের ওয়ালষ্ট্রীট কোম্পানীতে কর্মঅভিজ্ঞতা সত্বেও এদেশে কাউকে বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি।
তবে গতকাল, ৯ই অক্টোবর ২০১০ খ্রীঃ, দেশের প্রধান দু’টি ষ্টক এক্সঞ্জের সভাপতিদ্বয়ের সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে যৌথভাবে বিনিয়োগকারীদেরকে সতর্কীকরণ বিশেষ গুরত্ব বহন কারে বটে, বলে আমার মনে হয়।
তারা দু’জনেই দৃঢ়তার সাথে বলেছেন যে, বিনিয়োগকারীগণ যদি এখন সতর্ক না হন তাহলে বাজারে বিপর্যয়ের জন্য তারা নিজেরাই দায়ী থাকবেন।
ঢাকা শেয়ারবাজারে (ডিএসই) -র সভাপতি জনাব শাকিল রিজভি বিনিয়োগকারীদেরকে এ রকম “উতপ্ত বাজারে” “নিজ দয়িত্বে” অত্যন্ত ভেবে চিন্তে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে গত দু’সপ্তাহ ধরে বাজারের ঊর্ধ্বগতি সত্বেও তিনি আশু কোন পরির্তনের লক্ষণ দেখছেন না। এটা ভঙ্কর বলে তিনি মনে করছেন। বাজারের এ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে বিপর্যয় নিশ্চিত বলে তিনি আরও মন্তব্য করেন।
ঢাকা শেয়ারবাজারে (ডিএসই) গত সপ্তাহে পুরো সপ্তাহজুড়ে সাধারণ সূচকের ঊর্ধ্বগতি ছিল। এ ছাড়া বেশির ভাগ শেয়ারের মূল্য, আর্থিক লেনদেন ও বাজার মূলধন গত সপ্তাহে অনেকটা অযৌক্তিকভাবেই বেড়েছে।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে ঢাকা শেয়ারবাজারে সাধারণ মূল্যসূচক বেড়েছে ৩৮২ দশমিক ৯৫ পয়েন্ট। সপ্তাহের শুরুতে সাধারণ মূল্যসূচক ছিল ৭০৯৭ দশমিক ৩৮ পয়েন্ট। যা পুরো সপ্তাহের লেনদেন শেষে দাঁড়িয়েছে ৭৪৮০ দশমিক ৩৪ পয়েন্টে। এক সপ্তাহে সাধারণ মূল্য সূচকের ঊর্ধ্বগতির হার ৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
গত সপ্তাহে শেয়ারবাজারের আর্থিক লেনদেন প্রতিদিন গড়ে হয়েছে দুই হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। যার বৃদ্ধির হার ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ।
এদিকে ঢাকা শেয়ারবাজারের বাজার মূলধনও গত সপ্তাহে বৃদ্ধি পেয়েছে। সপ্তাহের শুরুতে যেখানে বাজার মূলধন ছিল তিন লাখ ১১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা, সেখানে সপ্তাহ শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ২৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায়। যা আগের চেয়ে ৪ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি।
একই সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম ষ্টক এক্সেঞ্জের সভাপতি জনাব ফকরউদ্দীন আলী আহম্মেদ বর্তমান “উতপ্ত” বাজারের নতুন আর কোন তারল্য সরবরাহ না করার জন্য বিনিয়োগকারীদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন। তাহলে আগুনে হাত পুরবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অপরদিকে বাজারে সরকারী প্রতিষ্ঠাণগুলোর শেয়ার ছাড়ার জন্য তাড়া দেওয়া হয়েছে এবং এ ব্যাপারে প্রধান মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে।
বর্তমান বাজার পরিস্থিতে বিনিয়োগকারীদেরকে সতর্ক করে দেওয়া বিচক্ষণ ও সময় উপযোগী।
কিন্তু তড়িঘড়ি করে, এমন কি স্বয়ং প্রধান মন্ত্রীর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সরকারী প্রতিষ্ঠাণসমূহের শেয়ার এরকম উত্তাল বাজারে ছাড়লেই যে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তা মনে করা অনুচিৎ হবে।
এতে করে প্রকৃত সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে বিনিয়োগকারীদের দঃশ্চিন্তা ও বাজারে অনিশ্চয়তা শুধু দীর্ঘায়িতই হবে না বরং হতে পারে জাতীয় অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
কারণ, যেখানে ব্যাক্তিমালিকানা কোম্পনীগুলো লভাংশ দিতে পারছে না, বিশ্ববাজারে মন্দার কারণে ভাল লাভ করতে পারছে না সেখানে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলে কি করে সমাধান দিবে তা বেধগম্য নয়। সরকারী কোম্পানীগুলো কি কখনও বেসকারী প্রতিষ্ঠাণগুলোর চেয়ে ভাল করতে পেরেছে?
তবে হ্যাঁ, যে সকল ব্যাবসায়ীদের সরকারী প্রতিষ্ঠাণগুলোকে এক পর্যায়ে পানির দামে কিনে নেওয়ার দুরভিসন্ধি রয়েছে তাদের জন্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে আশু প্রয়োজন। কারণ, বাজারে ছাড়ার কিছুদিন পর যখন কোম্পানীগুলে লভ্যাংশ দিতে ব্যার্থ হবে, শেয়ার বাজারের নিয়ম কানুন ভঙ্গ করবে, তখন সরকারকে হয় অতি চড়া মূল্যে শেয়ারগুলে ফেরৎ কিনতে হবে বাংলাদেশের করদাতাদের টাকা দিয়ে আর না হয় সরকারী বাকী শেয়ারগুলে পানির দামে বিনিয়োগকারীদের হাতে তুলে দিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে সর্বস্ব হারাবে – পরিণত হবে দেউলিয়া রাষ্ট্রে।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সরকারী নীতিনির্ধারকগণ যদি এই চান তাহলে তারা নিশ্চয় হন্তক্ষেপ করে বাজারে দ্রুত সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ছাড়বেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথাও মাথায় রাখতে হবে। যদি তাদের হস্তক্ষেপ শেয়ার বাজারের উপড় দিয়ে আইলার মত ঝড় বয়ে দেয়, বাংদেশের জাতীয় অর্থনীতেকে নিশ্চিত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়, তাহলে তাদের গদি ধরে রাখা সম্ভব হবে না বলে আমার বিশ্বাস।
একই সাথে আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, তরাও বিষয়টার সংবেদনশীলতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকেবহাল আছেন। তবুও আমার বিনীত নিবেদন এই যে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে ও সর্বপরি নিজেদের ক্ষমতার স্বর্থে কোন তড়িঘড়ি হস্থক্ষেপের পূর্বে বিষয়টা বিশেষ গুরত্বের সাথে গভীরভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে একটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হউক।
আর শেয়ার বাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীগণদের প্রতি আমার আকুল আবেদন এই যে, বিনিয়োগের পূর্বে আপনার বিনেয়োগের কৌশলটা স্থির করুন। তারপর, কোন কোন খাতে, কোন কোন ষ্টকে, কেন বিনিয়োগ করবেন, কতদিন পর্যন্ত কোন কোম্পনীর ষ্টকে কত মূলধন আটকে রাখবেন ইত্যাদী ঠিক করে তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
বাজারে শাড়ি কিনতে গেলে যেরকম শাড়ীর রঙটা দেখতে হয়, সুতাটা দেখতে হয়, বুননটা দেখতে হয়। শেয়ার বাজারের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। কোন কোম্পানীর ষ্টকে বিনিয়োগের আগে আপনাকে কোম্পনীর বিভিন্ন বিষয় যেমন অর্থনৈতিক অবস্থা, ব্যাবসার সম্ভাবনা, লাভলোকসানের হিসাব, স্থাবর অস্থাবর সম্পতি, পরিচালনা পর্ষদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা, কোম্পানী পরিচালনার দক্ষতা ইত্যাদী বিচার বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ কারাই শ্রেয়।
শুরুতে বলেছিলাম যে, বাঙ্গালীদের জুয়াখেলার অভ্যাস সনাতন। আবেক ভালবাসা অতুলনীয়। কিন্তু ভালবাসা দিয়ে পৃথিবী জয় করা গেলেও আবেক দিয়ে বিনিয়োগ কারা যায় না। জুয়া খেলে কাউকে ধনী হতেও শুনিনি।
আসলে শেয়ার বাজারে এ দু’টোর কোনটারই এক পয়সাও মূল্য নেই। শুধু সময়মত সঠিক তথ্য, নীবিড় বিশ্লেষণ ও বিশেষ জ্ঞানই শেয়ার বাজারে সফলতার মূলমন্ত্র।
বিনিয়োগকারীগণ কোন গুজবে কান না দিয়ে, আপাততঃ নুতন ষ্টক কেনা থেকে বিরত থাকলে, বুঝে শুনে ভেবে চিন্তে ঠান্ডা মাথায় বিনিয়োগ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে বিশেষ বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। -: সমাপ্ত :-
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। কাউছার ভূইয়াঁ ১৯৯১ – ২০১১। Oct 10, 2010 @ 10:14