বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে বিপর্যয় হঠাৎ করে আসেনি
প্রকাশিত: সাপ্তাহিক, ১৩ জানুয়ারী, ২০১১
বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে সাম্প্রতিক ধ্বস হঠাৎ করে আসেনি। এটা পুঞ্জিভূত অর্থনৈতিক (অবশ্য প্রধানতঃ রাজনৈতিক) সঙ্কটের ফলাফল মাত্র। গত কয়েক বছরে দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে পরেছে তিলেতিলে। দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে স্বল্পমেয়াদী প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে দেশের মানুষ আর দাতাদেরকে। কারণ, প্রধান উদ্দ্যেশ্য তো ধামাচাপা দিয়ে যেকোন মূল্যে ক্ষমতার গদি ধরে রাখা! তবে ক্ষমতার মূল উৎস, জনগণ যে তা একেবারে বুঝে না সেটা মনে করা বুদ্ধমানের কাজ হবে না। শেয়ার বাজার ধ্বংস হলে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে আগুন লাগলে আর জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে আমলা, রাজনীতিবীদ, নীতিনিধারক কারোরই গদি থাকবে না – পৃথিবীর কোথাও তা থাকেনি। এসব অতীত বর্তমান সব সরকারের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
যদিও রাজনীতি নিয়ে কথা বলে এদেশে বিশেষ কোন লাভ হয় না তবুও সমস্যার মূল কারণ ব্যাখ্যা না করার দায়ভার এড়াতে এটুকু বলতে হলো। বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির দিকে আলোকপাত করলে শঙ্কিত হতে হয় বৈকি। এদেশের অর্থনীতি এখন অনেকগুলো বড় সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলছে। মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে, প্রবাসী-আয়প্রবাহ শ্লথ হয়ে পড়েছে, গ্যাস-বিদ্যুৎ তথা জ্বালানী খাতের সঙ্ককট উত্তরণের কোনো লক্ষণ নেই, দেশী বিদেশী বিনিয়োগে চলছে মন্দা। এ অবস্থায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশে উন্নীত করা তো দূরের কথা, ৬ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়াটাই কঠিন হয়ে পড়বে বলে আপাততঃ মনে হচ্ছে। দেশের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা না চললে প্রবৃদ্ধি আসবে কোখা থেকে?
শেয়ার বাজারকে যদি অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ হিসাবে ধরা হয় তাহলেো তো কোন ভাল লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শেয়ার বাজারের কোম্পানীগুলি যদি ভালভাবে চলে, তবেই না সেগুলো লাভজনক ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত ভাল লভ্যাংশ প্রদান করতে পারে। তাহলে বিনিয়োগকারীগণ উৎসাহ পাবে, তাদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে – শেয়ার বাজারের গতি স্থায়ী হবে। কোম্পনীগুলোর মূল চালিকা শক্তি জ্বালানী, অবকাঠামো, কতৃপক্ষের কর্যক্রমের স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতা ইত্যাদীর মত গুরতর সমস্যা নিরসনর না হলে শেয়ার বাজারের ধ্বস কারচুপি, ছলচাতুরি বা জোর করে রোধ করা যাবে না। জ্বালানী, তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের অভাবে শিল্প কারখানায় উৎপাদন স্থবির হয়ে পড়েছে, নূতন গ্যাস সংযোগের অভাবে বিনিয়োগ বন্ধ। দেশব্যাপী কৃষী ও আবাদী জমির পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে একদিকে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা বেড়ে চলছে অন্যিদকে। ফলে চাল, ডাল, পেয়াঁজ, রসুন, তেলসহ প্রায় সবকিছুর মূল্য আকাশ চুম্বী। কৃষিখাতে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
বিখ্যাত আরিয়াল বিলের ২৫,০০০ একর উর্বর আবাদী ধানের জমি ধ্বংস করে নূতর বিমানবন্দর করলে খাদ্য সমস্যার প্রকট চাপ অরো বাড়বে বৈ কমবে না। দেশের আভ্যন্তরীণ ও আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরগুলেকে সংষ্কার করে আরো উন্নত করতে বাধা কোথায়?
বাংলাদেশ ব্যঙ্ক ও অর্থমন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা এবং ব্যর্থতার কারণে শিল্পঋণের অর্থ বিভিন্নভাবে পুঁজিবাজারে প্রবেশ করে বাজারের অতস্ফীতি ঘটিয়েছে। এই স্ফীতি যে টেকসই নয় সম্প্রতিকালে শেয়ার বাজারের ভয়াবহ দরপতন তা্রই প্রমাণ। সবচেয়ে বড় কথা, কৃষি ও শিল্প খাতে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি না পেলে এবং তা অব্যাহত না থাকলে অর্থনীতি এগিয়ে যেতে পারবে না। টেকসই কর্মসংস্থান হবে না। সম্পদ বণ্টনের অসাম্য প্রকটতর হবে। ফলে এক পর্যায়ে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
অন্তর্জাতি মূদ্রা তহবিল এবং ভারতে নিকট থেকে আত্মঘাতী শর্তসাপেক্ষে ঋণ গ্রহণে যাদের অধিক আগ্রহ তাদের কি একবারও এর পরিণম ভেবে দেখা উচিৎ ছিল না? গত কয়েক বছর অন্তর্জাতি মূদ্রা তহবিলের ঋণ না নিয়ে বাংলাদেশ তো এখনকার চেয়ে খারাপ চলেনি। মনে আছে কি, সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অন্তর্জাতি মূদ্রা তহবিলের সঙ্গে পলিসি সাপোর্ট ইন্সট্রুমেন্ট-বিষয়ক যে চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা নাগরিক সমাজের আপত্তির মুখে ব্যর্থ হয়েছিল? তহলে এখন কেন অন্তর্জাতি মূদ্রা তহবিলের ঋণ গ্রহণ করে জাতীয় স্বার্থবিরোধী শর্তের বেড়াজালে জড়াতে হবে? বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর নির্বাহী পরিচালক ডঃ মুস্তাফিজুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন যে, ভারতীয় ঋণের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো ঋণের টাকা দিয়ে বিশ্ব বাজারের চেয়ে ঊঁচু মূল্যে তাদের পণ্য ও সেবা ক্রয় করা। আরও কি কি শর্ত সেখানে আছে তা আমার আপাততঃ জানা না্ই। (পাঠকদের কারো কাছে শর্তগুলোর অনুলিপি থাকলে তা আর্ন্তজালে প্রকাশ করুন যাতে সকলে সে বিষয় অবগত হতে পারে।)
দেশের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করে শুধু সাময়িক প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চোখে ধূলা দিলে তা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে। শেয়ার বাজারের ঐতিহাসিক দরপতন তারই আলামত মাত্র। -: সমাপ্ত :-
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। কাউছার ভূইয়াঁ ১৯৯১ – ২০১১।